গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ ও চিকিৎসা
  আপনি কি গ্যাস্ট্রিক আলসারের সমস্যায় ভুগছেন? তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য।
  এই আর্টিকেলে গ্যাস্ট্রিক আলসারের সাধারণ লক্ষণ এবং কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে
  আলোচনা করা হবে।
  লক্ষণগুলো চিনে নিয়ে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করলে আলসারের ঝুঁকি ও জটিলতা কমানো
  সম্ভব।
  পেজ সূচিপত্রঃ গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ ও চিকিৎসা
গ্যাস্ট্রিক আলসার কী
  পাকস্থলীর দেয়ালে একটি সুরক্ষাকারী আস্তরণ থাকে, যা এসিড এবং পাচক রসের ক্ষতিকর
  প্রভাব থেকে পাকস্থলীকে রক্ষা করে। তবে, যদি ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে বা দীর্ঘদিন
  ধরে NSAIDs ওষুধ বেশি মাত্রায় সেবন করা হয়, তাহলে এই সুরক্ষার আস্তরণ দুর্বল
  হয়ে যায়।
আরো পড়ুনঃ ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা
    এর ফলে পাকস্থলীর আবরণ এসিডের সংস্পর্শে এসে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। এভাবেই
    গ্যাস্ট্রিক আলসার সৃষ্টি হয়।
  
  গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ
    গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পাকস্থলীর আলসারের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো পেটের মাঝখানে
    জ্বালাপোড়া বা স্থায়ী এক ধরণের ব্যথা। তবে আলসার থাকলেও সবার ক্ষেত্রে ব্যথা
    দেখা দেয় না। গ্যাস্ট্রিক আলসারের সাধারণ কিছু লক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো—
  
  - গ্যাস্ট্রিক আলসারের ব্যথা পেটের মাঝামাঝি থেকে ঘাড় বা পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে, এবং কখনো কখনো নাভি পর্যন্ত নামতে পারে।
- এই ব্যথা কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হতে পারে এবং বেশিরভাগ সময় খাবার খাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে দেখা দেয়।
- ডিওডেনাল আলসার থাকলে, অর্থাৎ পাকস্থলীর পরে অন্ত্রের প্রথম অংশে আলসার হলে, খালি পেটে ব্যথা শুরু হতে পারে।
    গ্যাস্ট্রিক আলসারের অন্যান্য লক্ষণগুলো হলো:
  
  - বদহজম
- বুকে জ্বালাপোড়া
- খাবারে অরুচি
- বমি বমি ভাব
- ওজন কমে যাওয়া
    কিছু মানুষের ক্ষেত্রে চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়ার পর পেট ফাঁপা বা ঢেঁকুর তোলার
    মত সমস্যাও হতে পারে। যদি আপনার পাকস্থলীর আলসারের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে
    অবশ্যই ডাক্তারকে দেখিয়ে নিশ্চিত হন। এছাড়া, নিচের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত
    ডাক্তারকে দেখান।
  
  
    রক্তবমিঃ বমির সাথে উজ্জ্বল লাল রঙের রক্ত বা খয়েরী রঙের চাকাচাকা বা
    দানাদার রক্ত থাকতে পারে, যা কফির দানার মতো দেখতে।
  
  
    পায়খানাঃ কালো, আঠালো পায়খানা যা আলকাতরার মতো দেখায়।
পেটে তীব্র ও তীক্ষ্ণ ব্যথাঃ যা হঠাৎ করে শুরু হয় এবং সময়ের সাথে বাড়তে
    থাকে।
  
    এই সব লক্ষণ শরীরের অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের মতো মারাত্মক সমস্যা নির্দেশ করতে
    পারে। তাই দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।
  
  গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসা
    গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধের ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
    যেমন-
  
  প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর বা PPI
    পেটের আলসারের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ গুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি হলো
    প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর বা পিপিআই। এই ঔষধগুলো পাকস্থলীতে এসিডের উৎপাদন কমিয়ে
    দেয়। ফলে আলসারের সাথে এসিডের সংস্পর্শ কমে, ফলে আলসারের ঘা দ্রুত সেরে ওঠে।
    পিপিআই সাধারণত ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত সেবন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিছু
    জনপ্রিয় পিপিআই ঔষধ হলো:
  
  - ওমিপ্রাজল
- ইসোমিপ্রাজল
- র্যাবেপ্রাজল
- প্যান্টোপ্রাজল/ Pantonix 20
- ল্যানসোপ্রাজল
    পিপিআই গ্রুপের ঔষধগুলোর কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এই
    পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো সাধারণত ঔষধ সেবন বন্ধ করার পর চলে যায়। তবে ডাক্তারের
    পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে বা অনিয়মিতভাবে গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ সেবন করলে হজমের
    সমস্যা, অস্টিওপোরোসিস (হাড় ক্ষয়) বা ভিটামিন বি ১২ এর অভাবজনিত রক্তশূন্যতা
    হতে পারে।
  
  অ্যান্টিবায়োটিক
    হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে আলসার হলে সাধারণত
    অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এর সাথে প্রোটোন পাম্প ইনহিবিটর (PPI) ধরনের
    ঔষধ যেমন- ওমিপ্রাজল বা পেন্টোপ্রাজলও দেয়া হয়। এই ইনফেকশনের চিকিৎসায় সাধারণত
    দুটি অ্যান্টিবায়োটিকের একসাথে কোর্স দেয়া হয়, যা প্রতিদিন দুইবার করে এক
    সপ্তাহের জন্য খেতে হয়।
  
  আরো পড়ুনঃ ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তির উপায়
  
    অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে অ্যামক্সিসিলিন, ক্ল্যারিথ্রোমাইসিন এবং মেট্রোনিডাজল
    ব্যবহার করা হয়। এসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলায় বারবার
    আলসার হওয়া রোধ হয়। অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কিছু মৃদু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা
    দিতে পারে।
  
  
    অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স শেষ হওয়ার পর অন্তত ৪ সপ্তাহ পরে H. pylori-এর উপস্থিতি
    পরীক্ষা করা হয়। যদি ব্যাকটেরিয়া উপস্থিত থাকে, তাহলে ভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের
    সাথে নতুন একটি কোর্স দেওয়া হয়।
  
  এইচ ২ রিসেপ্টর ব্লকার
    কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার পিপিআই (PPI) জাতীয় ঔষুধের পরিবর্তে ‘এইচ ২ (H2)
    রিসেপ্টর ব্লকার’ গ্রুপের ঔষুধ (যেমন: ফ্যামোটিডিন) সেবনের পরামর্শ দেন। কখনো
    কখনো বুকজ্বালা ও গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা দ্রুত কমাতে এন্টাসিড জাতীয় ঔষুধও দেওয়া
    হয়। নিয়মিত ঔষুধ সেবনের পর ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পরে পুনরায় এন্ডোস্কোপি করে আলসারের
    অবস্থান পরীক্ষা করা হয়।
  
  গ্যাস্ট্রিক আলসারের রোগ নির্ণয় ডায়াগনোসিস
    হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি সংক্রমণে পেটের আলসার হলে, তা নিশ্চিত করার জন্য নিচের
    পরীক্ষাগুলো করা হয়ঃ
  
  
    ইউরিয়া ব্রেথ টেস্টঃ রোগীকে একটি বিশেষ পানীয় খাওয়ানো হয়, পানীয়টির
    বিশেষত্ব হলো, এটি কেবল H. pylori ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে এসে একটি বিশেষ
    রাসায়নিক তৈরি করে। নিঃশ্বাসে সেই রাসায়নিক থাকলে H. pylori এর উপস্থিতি ধরা
    পড়ে।
  
  
    স্টুল অ্যান্টিজেন টেস্টঃ মল সংগ্রহ করে H. pylori এর উপস্থিতি পরীক্ষা
    করা হয়।
  
  
    H. pylori অ্যান্টিবডি টেস্টঃ রক্তে H. pylori এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি
    খুঁজে দেখা হয়। তবে এখন স্টুল অ্যান্টিজেন টেস্ট বেশি করা হয়।
  
  
    এন্ডোস্কোপিঃ এন্ডোস্কোপি বা গ্যাস্ট্রোস্কোপি পেটের ভেতরের অংশ দেখতে
    ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। আলসারের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য এটি করা হয়।
  
  পেটের আলসারের জন্য ঘরোয়া প্রতিকার
    কিছু ঘরোয়া প্রতিকার এবং জীবনধারার পরিবর্তন গুলি পেটের আলসারের প্রভাব কমাতে
    সাহায্য করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছেঃ
  
  - সহজে হজমযোগ্য ঠাণ্ডা, কম আঁশযুক্ত খাবারের প্রতি নজর দিন।
- অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার, অ্যাসিডিক পদার্থ, রসুন, পেঁয়াজ, গোলমরিচ, ক্যাফিন, কার্বনেটেড পানীয়, অ্যালকোহল, চকোলেট এবং ভাজা বা চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- খাবারের সাথে পানি পান করে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখুন।
- মশলাদার খাবার এবং ধূমপান বা তামাকজাত খাবারও খাওয়া উচিত নয়।
গ্যাস্ট্রিক আলসারের কারণ
    গ্যাস্ট্রিক আলসারের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি
    ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ এবং দীর্ঘদিন নন-স্টেরয়ডাল প্রদাহনাশক ওষুধ (NSAIDs)
    সেবন। পাকস্থলীতে উৎপন্ন হওয়া এসিড এবং অন্যান্য পাচক রস খাবার হজমে
    গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাভাবিকভাবে পাকস্থলীর দেয়ালে একটি
    সুরক্ষাকারী আস্তরণ থাকে,
  
  
    যা এসিড এবং পাচক রসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পাকস্থলীকে রক্ষা করে। তবে, যদি H.
    pylori ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে বা দীর্ঘদিন ধরে NSAIDs বেশি মাত্রায় সেবন করা
    হয়, তাহলে এই সুরক্ষার আস্তরণ দুর্বল হয়ে যায়। এর ফলে পাকস্থলীর দেয়াল
    এসিডের সংস্পর্শে এসে পাকস্থলীর আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। তখন
    গ্যাস্ট্রিক আলসার সৃষ্টি হয়।
  
  ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে পেটে আলসার
    হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি (H. pylori) নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ অনেক
    মানুষের মধ্যে দেখা যায়, যা যেকোনো বয়সের মানুষকেই প্রভাবিত করতে পারে।
    বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সংক্রমণ কোনো লক্ষণ ছাড়াই হয়, ফলে অনেকে বুঝতে পারেন
    না যে তারা আক্রান্ত।এই ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলীর দেয়ালে বসবাস করে এবং কখনও
    কখনও পাকস্থলীর আস্তরণে প্রদাহ সৃষ্টি করে।
  
  আরো পড়ুনঃ ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা
  
    এতে পাকস্থলীর এসিড সহজেই আস্তরণে আঘাত হানে, যা পেটের আলসার বা ক্ষতের কারণ
    হতে পারে। সবাই H. pylori সংক্রমণে সমান ঝুঁকিতে থাকেন না। কিছু মানুষের
    ক্ষেত্রে এই ব্যাকটেরিয়া সহজেই প্রদাহ তৈরি করে, কিন্তু কেন সবার মধ্যে ঝুঁকির
    এই পার্থক্য রয়েছে তা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়।
  
  প্রদাহ নাশক ঔষধ সেবনে পেটে আলসার
    NSAIDs বা নন-স্টেরয়ডাল প্রদাহনাশক ওষুধ হলো এক ধরনের ব্যথানাশক যা জ্বর,
    ব্যথা, আর্থ্রাইটিস সহ নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মধ্যে
    জনপ্রিয় কিছু ওষুধ হলোঃ
  
  - আইবুপ্রোফেন
- অ্যাসপিরিন
- ন্যাপ্রোক্সেন
- ডাইক্লোফেন্যাক
- এসিক্লোফেন্যাক
    অনেকেই NSAIDs ব্যবহার করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করেন না। তবে উচ্চ ডোজ বা
    দীর্ঘমেয়াদে এসব ওষুধ ব্যবহারে বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকি থাকে, যার মধ্যে
    পাকস্থলীতে আলসার হওয়া অন্যতম। যাদের গ্যাস্ট্রিক আলসারের সমস্যা আছে বা আগে
    হয়েছে, তাদের NSAIDs এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। 
  
  
    বিকল্প হিসেবে প্যারাসিটামল ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়, যা সাধারণত নিরাপদ
    বলে বিবেচিত হয়। এছাড়া, NSAIDs গ্রুপের মধ্যে কিছু ঔষধ আছে, যা সাধারণত আলসার
    সৃষ্টি করে না। বিকল্প হিসেবে এসব ঔষধও নির্বাচন করা যেতে পারে।
  
  বদভ্যাসের কারণে পেটের আলসার
    ধূমপানের অভ্যাস পাকস্থলীর আলসারের ঝুঁকি অনেকটাই বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া,
    ধূমপানের ফলে আলসারের চিকিৎসার কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
    তাই গ্যাস্ট্রিক আলসার প্রতিরোধে এবং চিকিৎসার অংশ হিসেবে ধূমপান ত্যাগ করা
    অত্যন্ত জরুরি।
  
  আরো পড়ুনঃ পেট ব্যথা কিসের লক্ষণ
  
    আগে মনে করা হতো মশলাদার খাবার, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ও মদপানের কারণে আলসার
    হয়। তবে এসব ধারণার পক্ষে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকলেও, যাদের গ্যাস্ট্রিক
    আলসার রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এসব অভ্যাসে আলসারের লক্ষণগুলো আরও তীব্র হতে পারে।
  
  শেষ কথাঃ গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ ও চিকিৎসা
    উপরোক্ত আলোচনায় আমরা গ্যাস্ট্রিক আলসারের বিভিন্ন দিক যেমন লক্ষণ, কারণ এবং
    চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি।
  
  
    উপসংহারে বলা যায়, গ্যাস্ট্রিক আলসারের সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সম্পূর্ণ
    নিরাময় সম্ভব। তবে, দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা সৃষ্টির আগেই এই রোগটি শনাক্ত করা এবং
    চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।
  
  
  
 

চাঁপাই আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url